বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার আজ এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। এ হত্যাকা-ের মামলায় মাত্র এক মাসের মধ্যেই চার্জশিট দিয়েছিল ডিবি পুলিশ। অথচ বিচার শুরু হতেই লেগে গেছে ১১ মাস, তাও প্রথম ধাপে কেবল চার্জই গঠন হয়েছে। এ মামলায় গতকাল সোমবার আবরারের বাবা বরকতউল্লাহ আদালতে সাক্ষ্য দেন। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ১-এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
দুপুর ১২টা থেকে প্রায় ৩৫ মিনিটের জবানবন্দিতে আবরারের বাবা বলেন, ‘আসামিরা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে আমার ছেলেকে ছয় ঘণ্টা ধরে অমানবিকভাবে শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছে। আমি এই হত্যাকা-ের ন্যায়বিচার চাই।’ এ সময় তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। সেই সময় আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা বুয়েটের ২২ ছাত্র ছিল চুপ। মামলার কার্যক্রম শুরুর আগেই তাদের কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়।
ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া কেন্দ্র করে গত বছর ৬ অক্টোবর রাতে ছাত্রাবাসে আবরারকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে বুয়েট ছাত্রলীগের কর্মীরা। ঘটনার পর দিনই আবরারের বাবা বরকতউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়টির ১৯ শিক্ষার্থীকে আসামি করে চকবাজার থানায় মামলা করেন। নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে একদিন পরই মামলাটি হস্তান্তর করা হয় ডিবিতে। মাত্র ৩৩ দিনেই অর্থাৎ গেল বছরের ১৩ নভেম্বর আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন ডিবি পুলিশের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. ওয়াহিদুজ্জামান। এর পর নানা আইনি কার্যক্রম চললেও দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে এ মামলার বিচারও দীর্ঘদিন স্থগিত ছিল। সম্প্রতি তা আবার শুরু হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আবরারের বাবা গতকাল আদালতে সাক্ষ্য দেন।
আবরারের বাবা বরকতউল্লাহ আদালতকে জানান, তিনি একটি এনজিওতে চাকরি করেন। তার ছেলে বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। সে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের নিচতলায় ১০১১ নম্বর কক্ষে থেকে লেখাপড়া করত। গত বছরের ৭ অক্টোবর ফজরের আজানের পর তিনি ফোনে জানতে পারেন, তার ছেলে আবরারকে মারধরের পর গুরুতর জখম করে হত্যা করা হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি শেরেবাংলা হলের কিছু ছাত্র ও শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করেন। পরে ঢাকায় এসে তিনি ছেলের হলে যান এবং আলোচনা করেন হল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখেন। তখন জানতে পারেন হলের ছাত্র মেহেদী হাসান রাসেল, মুহতামিম ফুয়াদ, মো. অনিক সরকার, মেহেদী হাসান রবিন, মো. মনিরুজ্জামান মনির, মো. মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মো. মাজেদুর রহমান মাজেদ, মো. মুজাহিদুর রহমান, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর, হোসেন মোহাম্মাদ তোহা, মুহাম্মাদ মোর্শেদ-উজ-জামান ম-ল ওরফে জিসান, আকাশ হোসেন, শামীম বিল্লাহ, এএসএম নাজমুস সাদাত, এহতেশামুল রাব্বি ওরফে তানিম, মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম, মুনতাসির আল জেমি, মুয়াজ ওরফে আবু হুরায়রাসহ অজ্ঞাত আরও কয়েকজন ছাত্র তার ছেলেকে ৬ অক্টোবর রাত ৮টা ৫ মিনিটের দিকে হত্যার উদ্দেশ্যে ডেকে নিয়ে যায়। রাত ৮টা ৫ মিনিট থেকে ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত হলের ২০০৫ নম্বর কক্ষে তারা আবরারকে লাঠিসোটা এবং দড়ি দিয়ে প্রচ- মারধর করে। পরে ঘটনাস্থলেই আবরার মারা যায়। সে সময় আসামিরা আবরারের লাশ হলের দ্বিতীয় তলায় ফেলে রাখে। পরে কতিপয় ছাত্র তার ছেলেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এর পর তিনি চকবাজার থানায় ছেলের হত্যার বিচার চেয়ে হত্যা মামলা করেন।
আবরারের বাবার জবানবন্দি শেষ হলে আসামিপক্ষের আইনজীবী মাহবুব আহমেদ তাকে জেরা শুরু করেন। তবে জেরা অব্যাহত থাকাবস্থায় আদালতের সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণ মুলতবি করেন বিচারক। সাক্ষ্যগ্রহণকালে রাষ্ট্রপক্ষে প্রসিকিউটর মো. আবু আবদুল্লাহ ভূঁইয়া এবং রাষ্ট্র ও বুয়েটের নিয়োগকৃত প্রসিকিউটর এহসানুল হক সমাজী সহায়তা করেন।
গত বছরের ১৩ নভেম্বর জমা দেওয়া মামলার চার্জশিটে এজাহারভুক্ত ১৯ জনসহ বুয়েটের ২৫ শিক্ষার্থীকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে চার আসামি তখন পলাতক ছিল। তাই চার্জশিট দাখিল হওয়ার পর প্রথমে সিএমএম আদালত পলাতকদের গ্রেপ্তারে পরোয়ানা, পরে সম্পত্তির ক্রোকাদেশ এবং শেষে অনুপস্থিতিতে বিচারের বিষয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেন। এ প্রক্রিয়ার মধ্যেই গত ১২ জানুয়ারি বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৭তম ব্যাচের ছাত্র মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম আদালতে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যান। এর পর অপর তিন আসামি পলাতক থাকাবস্থায়ই ১৫ জানুয়ারি মামলার নথি সিএমএম আদালত থেকে মহানগর দায়রা জজের বিচারিক আদালতে যায়। সেখানে পাঁচ দিন পর অর্থাৎ ২১ জানুয়ারি মহানগর দায়রা জজ কেএম ইমরুল কায়েস আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট আমলে নিয়ে ৩০ জানুয়ারি চার্জগঠনের শুনানির দিন ঠিক করেন। তবে ধার্য তারিখে জানানো হয়, মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে যাবে। তাই চার্জ গঠনের কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়। প্রজ্ঞাপন হলে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ১-এ ৬ এপ্রিল চার্জ গঠনের শুনানির দিন ধার্য করে বদলির আদেশ দেন মহানগর দায়রা জজ আদালত। কিন্তু ৬ এপ্রিলের আগেই করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশের সব আদালতের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
আগস্টে সরকার আদালত খুলে দেওয়ায় গত ২ ও ৯ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনাল এ মামলায় চার্জ গঠনের শুনানি হয়। গত ১৫ সেপ্টেম্বর কারাগারে থাকা ২২ আসামির অব্যাহতির আবেদন নাকচ করে পলাতক তিনজনসহ ২৫ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের মাধ্যমে বিচারকাজ শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। ওই দিনই ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত ১০টি ধার্য তারিখ সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য নির্ধারণ করেন বিচারক। কিন্তু প্রথম ধার্য তারিখে ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হলেও বাদী বরকতউল্লাহ জন্ডিসজনিত অসুস্থতায় ভুগছেন জানিয়ে সময় চায় রাষ্ট্রপক্ষ। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৫ থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত একটানা সাক্ষ্যগ্রহণের নতুন দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।
মামলার আসামিরা হলেন- বুয়েট ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক (বহিষ্কৃত) মো. অনিক সরকার, উপ-সমাজসেবাবিষয়ক সম্পাদক (বহিষ্কৃত) ইফতি মোশাররেফ সকাল, ক্রীড়া সম্পাদক মো. মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, সাংগঠনিক সম্পাদক (বহিষ্কৃত) মেহেদী হাসান রবিন, মো. মনিরুজ্জামান মনির, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর, শিক্ষার্থী মো. মুজাহিদুর রহমান ও এএসএম নাজমুস সাদাত, বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক (বহিষ্কৃত) মেহেদী হাসান রাসেল, আইনবিষয়ক উপসম্পাদক (বহিষ্কৃত) অমিত সাহা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (বহিষ্কৃত) মুহতামিম ফুয়াদ, কর্মী মুনতাসির আল জেমি, গ্রন্থ ও প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক (বহিষ্কৃত) ইসাতিয়াক আহম্মেদ মুন্না, আবরারের রুমমেট মিজানুর রহমান, শিক্ষার্থী শামসুল আরেফিন রাফাত, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আকাশ হোসেন, শিক্ষার্থী মো. মাজেদুর রহমান মাজেদ, শামীম বিল্লাহ, হোসেন মোহাম্মাদ তোহা, মুয়াজ ওরফে আবু হুরায়রা, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৭তম ব্যাচের ছাত্র মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম ও এসএম মাহমুদ সেতু, ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স বিভাগের ১৭তম ব্যাচের ছাত্র মুহাম্মাদ মোর্শেদ-উজ-জামান ম-ল ওরফে জিসান, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৭তম ব্যাচের ছাত্র এহতেশামুল রাব্বি ওরফে তানিম এবং কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচের ছাত্র মুজতবা রাফিদ (২১)। এদের মধ্যে প্রথম আটজন আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। আর শেষের তিনজন ছাড়া বাকি সবাই কারাগারে রয়েছেন।
এদিকে বিচার শুরুর আগে এ মামলায় গত ২ জুলাই অ্যাডভোকেট মোশারফ হোসেন কাজলকে প্রধান করে তিন সদস্যের প্রসিকিউটর প্যানেল নিয়োগ দেয় সরকার। অপর দুজন হলেন- সিনিয়র আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী ও দ্রুত বিচার ১-এর প্রসিকিউটর মো. আবু আবদুল্লাহ ভূঁইয়া। পরে গত ২৪ আগস্ট প্যানেল সদস্য অ্যাডভোকেট এহসানুল হক সমাজীকে বাদীপক্ষের আইনজীবী হিসেবেও নিয়োগ দেয় বুয়েট।
বিচার বিলম্ব নিয়ে গত রবিবার আদালতে আসা নিহতের বাবা বরকতউল্লাহ বলেন, ‘করোনাসহ বিভিন্ন কারণে বিচার বিলম্ব হয়েছে। এখন আর যেন বিলম্ব না হয়। আশা করছি দ্রুততার সঙ্গেই মামলার বিচার শেষে রায় হবে এবং আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।’ আইনজীবী সমাজী বলেন, ‘বিচার কিছুটা করোনার কারণে বিলম্ব হয়েছে। তবে আর হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ধারাবাহিকভাবে এখন প্রতিদিনই বিচার চলবে বলে আশা করছি। ট্রাইব্যুনাল সেভাবেই তারিখ ধার্য করেছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের হাতে আট আসামির দোষ স্বীকারোক্তির জবানবন্দি রয়েছে, যা সব আসামির এ হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত মর্মে সম্পৃক্ততা প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া ডিজিটাল ডকুমেন্ট ভিডিও ফুটেজ ও মৌখিক ডকুমেন্টও আছে। এসব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়ার ব্যাপারে যৌক্তিক কারণ হিসেবে কাজ করবে।’
অন্যদিকে আসামি জিয়ন, সেতু ও শামীমের পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফারুক হোসেন বলেন, ‘মনে হয় মামলাটা নিয়ে একটু তাড়াহুড়া হচ্ছে। ৫ অক্টোবর থেকে ২৭ অক্টোবর ১৭টি ধার্য তারিখ সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য রাখা হয়েছে। বিচার দ্রুত হোক আমরাও চাই। তবে এত দ্রুত নয় যে, যার কারণে আসামিরা প্রস্তুতির অভাবে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন।’
Leave a Reply